
ইসলামি পুনর্জাগরণের কবি ফররুখ আহমদ এর “সাত সাগরের মাঝি” অন্যতম বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থটি ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে যাতে মোট ১৯ টি কবিতা সংযোজিত হয়েছে। সার্বিকভাবে এই গ্রন্থের কবিতা গুলো মূলতঃ ইসলামের পুনর্জাগরণকে কেন্দ্র করে রচিত।
কবি এখানে বিভিন্ন রূপক বা কল্পরূপ ব্যবহার করে ইসলামের সুমহান ঐতিহ্য তুলে ধরেছেন এবং একান্ত ভাবে চেয়েছেন সেই হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে। কবি বলেছেন- মুসলমানদের অনেক আরাম-আয়েশের দিন কেটেছে, কিন্তু আজ তারা অসহায়-মজলুম। তাদের এই জীর্ণাবস্থা থেকে ফিরাতে সিন্দবাদের মত দক্ষ নাবিকের প্রয়োজন। যে কিনা শত বাধা-বিপত্তির পাহাড় ডিঙিয়ে জাতিকে আলোর পথ দেখাবে।
“কেটেছে রঙিন মখমল দিন, নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক” (সিন্দবাদ)
একজন আপোষহীন নেতা প্রয়োজন; যার কাছে জীবন মানে সংগ্রাম; যার কাছে কণ্টকাকীর্ণ পথেও রয়েছে আশার প্রদীপ। সবাই তার পাবে ছুটবে আশ্রয়ের জন্য।
” রাত্রে ঝড় উঠিয়াছিল; সুবহে সাদিকের ম্লান রোশনিতে সমুদ্রের
বুক এখন শান্ত। কয়েকজন বিমর্ষ মাল্লা সিন্দবাদকে
ঘিরিয়া জাহাজের পাটাতনে আসিয়া দাড়াইলো।” (দরিয়ার শেষ রাত্রি)
কবিতা গুলিতে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের ফলে মনেহয় সমস্তই ইসলাম নির্ভর। কিন্তু একটু ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচনা করলে আমরা কবির স্বদেশ প্রেমকে উপলব্ধি করতে পারি। স্বদেশের দূরবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে যিনি একজন দক্ষ নেতৃত্বের আহবান জানিয়েছেন। যে নেতৃত্ব জাতিকে দুঃখ-দূর্দশা থেকে মুক্তি দিতে পারবে। যেমন সিন্দবাদ তার সহচরদের বলছে-
“শুনতে কি পাও দূর ও’তানের টান?
মাঝি মাল্লার দল!
দরিয়ার বুকে শেষ হ’ল সন্ধান?
ডাকছে খাকের গভীরে স্নেহ অটল? (দরিয়ার শেষ রাত্রি)
এই কথা গুলোর দ্বারা কবির প্রবল স্বদেশ ভাবনার জাগ্রত রূপ পরিলক্ষিত হয়।
কবি তার লেখায় কোন আফসোস ফুটিয়ে তোলেননি। বরং বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুর্দশাকে তিনি আগামী দিনের ভালো নেতৃত্বের প্রস্তুতি নেয়ার সময় হিসাবে উল্লেখ করেছেন-
“এইসব রাত্রি শুধু একমনে কথা কহিবার
নিজেদের সাথে” (এইসব রাত্রি)
তিনি নিজেদের ভুল স্বীকার করে নিয়ে এমন এক পথপ্রদর্শকের আকাঙ্ক্ষা করেছেন যিনি জাতির সামনে জবাবদিহিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তুলে ধরবে।
“পাঞ্জেরী!
জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রূকুটি হেরি;
জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রূকুটি হেরি ;” (পাঞ্জেরী)
যেখানে পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ ভারী হয়ে উঠবে না, শোষকের শাসন প্রতিষ্ঠা থাকবে না, শ্রমিকের রক্তে কারো পানপাত্র সাজবে না। যে সমাজে শিশুরা সুন্দরভাবে বেড়ে উঠবে; ধর্ষণ-ব্যভিচারের মৃত সমাজ মুক্তি পাবে যার মাধ্যমে।
“পাওনি এখনো আলোর পরশ নবজীবন?
মৃত শব হতে হয়নি কি আকো উজ্জীবন
…..
তবু এই চলা জানি উদয়ের পূর্বাভাস”
এ ধরনের যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের উদাহরণও টেনেছেন ইতিহাস থেকে। যারা সুমহান ঐতিহ্য ও সভ্যতার বুনিয়াদ গড়েছিলেন।
“খালেদের হাতে, তারেকের হাতে, হ’য়েছ সওয়ার,
উমর আলির হাতের নিশান নবীজীর দান” (নিশান)
সবশেষে কবি বলেছেন এই নেতৃত্ব এক গুরুভার। ভেতরের সমস্ত দূর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে হবে। সামান্য ভুলে বা অবহেলার কারণে সমাজ-সভ্যতা আবার বহু দিনের জন্য আবার পিছিয়ে যেতে পারে।
“দিন রাত্রির বোঝা হ’ল আজ দুঃসহ গুরুভার,
স্থলিত পথীর আয়োজন চলে পশ্চাৎ যাত্রার,” (নিশান-বরদার)
সর্বপরি ফররুখ আহমদ কাতরভাবে, অত্যন্ত অনুযোগের স্বরে, প্রবল চিত্তে প্রতীক্ষিত ব্যক্তির আহবান করেছেন। সময় যেন দরজায় কড়া নাড়ছে; এখনই সময় যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে জাতিকে নিয়ে ঘুরে দাড়ানোর। নইলে এ সম্ভাবনাময় জাতি আবার আবার পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে। সকল আশার প্রদীপ নিভে গিয়ে নিরাশার কালো মেঘে ছেয়ে যাবে সবকিছু।
“দুয়ারে তোমার সাত-সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?” (সাত সাগরের মাঝি)
পরিশেষে এটুকুই বলার যে, কবি এই কাব্য গ্রন্থটিতে সুন্দর এবং নিখুঁতভাবে কল্পরূপের সাহায্যে ঐতিহ্যের বর্ণনা দিয়েছেন এবং বর্তমান দূর্দশাগ্রস্ত সময়ের কথাও বলেছেন। সেই সাথে তীব্রভাবে আকাঙ্ক্ষা করেছেন একজন যোগ্য এবং বলিষ্ঠ সংস্কারকের যিনি বিপদ সঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে চারিদিক নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করবেন।
মন্তব্য করুনঃ