
আখতারুজ্জামান আজাদের ‘উসকানিমূলক গল্প’ পড়লাম। পাঠপ্রতিক্রিয়া বলতে গেলে আক্ষরিক অর্থেই আমি ‘উসকে’ উঠেছি। শব্দে শব্দে দুর্দান্ত দ্যোতনা, বাক্যে বাক্যে বিশেষ ব্যঞ্জনা আমাকে অসম্ভব আলোড়িত করেছে। ছন্দময় আন্দোলনে উছলে উঠেছে অন্তর্জগত। দীর্ঘদিন ধরে আজাদের লেখা পড়ি। তবে বৃহত্ কলেবরে বর্ধিত অবসরে সুদীর্ঘ সময় ধরে তার গল্পের সরোবরে ডুব দেওয়ার পর অনুভূতি একেবারেই অনন্য। পরাক্রমী পদ্যভঙ্গির এই গদ্যগল্প সদ্য শেষ করার পর এখন অন্য সব রচনা অখাদ্য মনে হচ্ছে। অন্তহীন অনুপ্রাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা হৃদয়ের গহীনে গুনগুন গুঞ্জন তোলা এই বাদ্য আমাকে তার বিশেষ লেখ্যরীতির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হতে বাধ্য করেছে।
সঙ্গীতসুরেলা বাগভঙ্গি একপাশে সরিয়ে গল্পে নজর দিলে সেখানেও কল্পনাতীত আল্পনার দেখা পাই। প্রতিটি লেখার শুরুর শব্দসমষ্টি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে আবিষ্কার করি চৈতন্যহীন চোরাস্রোতে। সেই স্রোত টেনে নিয়ে যায় ঘটন-অঘটনের এ ঘাট থেকে ও ঘাটে। বাঁকে বাঁকে ততটা রহস্য ও রোমাঞ্চ পাইনি, তবে পেয়েছি ঝাঁক ঝাঁক সহাস্য-সরস সংলাপ। বিস্মিত ও আকর্ষিত হয়েছি শত সহস্র সেন্স অব হিউমারে। কথার কারুকাজে অর্থের মারপ্যাঁচে হঠাত্ হঠাত্ হো হো করে হেসে উঠেছি। ঘূর্ণায়মান ঘটনায় ঝুমঝুম ছন্দে দুলতে দুলতে উপরে উঠেছি, আবার দুম করে পড়ে গেছি গর্তের গভীরে। গতিময় গল্পে গতানুগতিক গন্তব্যের আগেই টসটসে টুইস্ট দেখে টলে গিয়েছি।
গল্পগ্রন্থের শুরু ‘পহেলা এপ্রিল’ দিয়ে। এই আখ্যানটি অশ্রুঅনুভবে একাকার ও ভালোবাসায় ভারাক্রান্ত করার গল্প। নাজের নিখাদ প্রেমের নির্মোহ জীবনের স্বপ্ন নিরীহ নায়ক শরিফের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে সমাধা হয়েছে। বেশি ভালো লেগেছে ‘জোয়ার্দার জংশন’। কেন লেগেছে তা নির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করতে পারিনি। চেহারায় চটক আর চরিত্রে চমক এনেছে ‘চিত্রামহলের’ সুচিত্রা ও ফরিদ। ‘প্রক্সি’ গল্পে প্রস্ফুটিত হতে দেখেছি চিত্রজগতের কদর্য সৌন্দর্য। ‘দৈনিক দাবানলের’ দায়িত্ব পাঠক হিসেবে নিজের জিম্মায় না নিয়ে লেখকের পরিচালনায় পরিণতি দেখার সাধ জেগেছিল। দূর্গার ‘আঠারো হাজার লাইক’ পাওয়ার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাণ্ডে কথিত নারীবাদীদের নারকীয় চিন্তাতাণ্ডব প্রকাশ পেয়েছে। শিল্পের ষোলোকলায় ও গল্পের গভীরতায় অন্যরকম উচ্চতায় দেখেছি ‘চোখ’।
সারমর্মে বলতে গেলে বইয়ের অধিকাংশ গল্পে ঘুরেফিরে একই আলোচ্য ও উপজীব্যের আরাধনা মনে হয়েছে। আর তা হচ্ছে ঝলকানো জীবনের ঝলসিত রূপ ও যৌনতার জখম। বিষয়বৈচিত্র্যে আরও সমৃদ্ধ ও স্বতন্ত্র গল্পশিল্পের অপেক্ষায় থাকব সামনের দিনগুলোতে। সেই সক্ষমতা ও সার্থকতার স্বাক্ষর ইতোমধ্যেই রেখেছেন আখতারুজ্জামান আজাদ ।
মন্তব্য করুনঃ